পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা এবং শিল্প হিসাবে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ কি-

পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা এবং শিল্প হিসাবে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ কি-

সোনারগাঁ জার্নাল;

 

পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা এবং শিল্প হিসাবে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ কি-এই প্রশ্ন একেবারেই নতুন নয়। আন্তর্জাতিকভাবেই আলোচিত একটি ইস্যু। গতানুগতিক সাংবাদিকতা বা সংবাদমাধ্যম শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে কিনা- এ প্রশ্ন এখন বাংলাদেশেও প্রবল ভাবে। সামাজিক গণমাধ্যমের বিস্তৃতি ও জনপ্রিয়তায় কোণঠাসা গণমাধ্যমের জন্য আবার মাঝে মধ্যে ভালো খবর যে আসছে না তাও নয়। ভালো মন্দ নিয়ে এ টানাপড়েনের মধ্যে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য বিশেষ ভাবে খারাপ খবরই বেশি আসছে সা¤প্রতিক বছরগুলোতে।

 

এক সাংবাদিক ফেসবুকে স্ট্যাটাসে বলেছেন, এ দুর্বল পেশায় যারা এখন রয়েছেন তাদের সাংবাদিকতা ত্যাগের এখন সময় এসেছে। তিনি শিক্ষার্থীদের সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা না করার জন্য অনুরোধ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ নতুন করে না খোলা অথবা বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করেছেন, অন্যকেও পেশাটি বেছে নিতে অনুরোধ না করার জন্যও বলেছেন। তার মন্তব্য, আপনি সাংবাদিক হওয়ার জন্য নিজেকে কষ্ট দেবেন, হতাশ হবেন এবং একসময় অভিশাপ দেবেন। এখানে কোনও অর্থ নেই, কোনও সুখকর জীবন নেই, এ পেশার এখন আর কোনও দৃশ্যমান বিকাশ নেই, কোনও সামাজিক স্বীকৃতিও নেই। একসময় আমরা এ পেশাটি উপভোগ করতাম, এখন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পেশায় থাকার জন্য নিজেকে কেবলই অভিশাপ দিই।

 

সাংবাদিক বন্ধুর আবেগঘন বক্তব্যের অনেক কিছুর সাথে একমত হবার মতো হলেও এটা ভাবা কঠিন বাংলাদেশের সৎ, গঠনমূলক ও মর্যাদাকর সাংবাদিকতার জন্য সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাংবাদিকতাকে সন্দেহাতীত ভাবে বদলে দিয়েছে। ছাপা পত্রিকার মাধ্যমে সকালে পাঠকদের হাতে পৌঁছানোর বহু আগেই সেই সংবাদ ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠক পড়ে ফেলেন।

 

ছাপার মাধ্যমে প্রচারসংখ্যা কমে যাওয়াটা বিশ্বজুড়েই ঘটছে। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর ছাপা মাধ্যম ব্যাপক ভাবে বেসরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করে। বিশ্বব্যাপী ছাপা মাধ্যমের প্রচার কমে আসায় পত্রিকাগুলো কয়েক বছর আগেও যে পরিমাণ বিজ্ঞাপন পেত এখন আর তা আর পাচ্ছে না। অপর দিকে, ইন্টারনেটনির্ভর সংবাদ প্রচারের মাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। কিন্তু সেই হিসেবে এখনো অনলাইন প্লাাটফর্মগুলোকে টেকসই আয়ের উৎস বানানো যায়নি। এ জটিল পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের সামনে বিকল্প আয়ের উৎস খোঁজা ছাড়া উপায় নেই। সেই সঙ্গে চলে আসছে পত্রিকা চালানোর ব্যয় কমানোর বিষয়টি। শিল্প বলি অথবা গণমাধ্যমই বলি, কোন উদ্যোক্তাই লোকসান দিয়ে তার উদ্যোগ বা ব্যবসা চালিয়ে যাবেন না। যেকোনো পত্রিকা মালিককে নিজের ব্যবসা বাঁচানোর জন্য লোকসান থেকে লাভে উত্তরণের কথা ভাবতে হবে।

 

ফিলিপ মেয়ার এর ‘দ্য ভ্যানিশিং নিউজপেপার’ নামে একটি বই আছে। এই বইয়ে ‘হারভেস্টিং দ্য প্রোডাক্ট’ বলে একটা ধারণা তিনি দিয়েছেন। গণমাধ্যম জগতে এটি বেশ আলোচিত। সেখানে তিনি পত্রিকার কর্মী আর প্রচারসংখ্যা কমানোর মাধ্যমে ব্যয় কমানোর কথা বলেছেন। আর একই সঙ্গে বিজ্ঞাপনের হার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। বলা হচ্ছে, দেশে-বিদেশে বহু সংকটাপন্ন পত্রিকা এ মডেল গ্রহণ করেছে।

 

গণমাধ্যমের অনেক মালিককে এখন তার অন্য বৈধ/অবৈধ ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থসম্পদ রক্ষার জন্য সংবাদ মাধ্যমকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। বিনিয়োগ ক্ষেত্র না হয়ে সুযোগ সুবিধার জন্য ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার ফলে গণমাধ্যম ক্ষেত্র বিশেষে বø্যাকমেইলের হাতিয়ার হচ্ছে। জাতীয় দৈনিকগুলি এবং বৈদ্যুতিন মিডিয়াগুলির বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং সম্পাদকদের প্রায়শই সরকারকে তোষামোদি করতে দেখা যায়। আর এটি দেখে টিভি দর্শকরা সুবিধাবাদিতা ও কাপুরুষতার জন্য সাংবাদিকদের ব্যাপারে আশাহত হয়, অনেক ক্ষেত্রে ঘৃণাও করে।

 

এছাড়া অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, সাংবাদিকরা বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হয় না, নৈতিক অবস্থান ত্যাগ করে সংবাদপত্র প্রকাশক বা চ্যানেল টিভি মালিকদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্র এবং ডিজিটাল সুরক্ষা আইনের শিকার হবার মতো পরিস্থিতিতে প্রকাশক ও সম্পাদকরা পড়তে চান না বলে সাংবাদিকরা যা দেখেন তা বস্তুনিষ্ঠ ভাবে লিখতে পারেন না। আবার বেতন ভাতার অনিয়ম ও অপর্যাপ্ততার কারণে নৈতিক ভাবে অনেক সংবাদকর্মী টিকে থাকতে না পেরে অসততার কাছে নতও হয়ে পড়েন।

 

এতোকিছুর পরও ছাপা প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশে এখনো গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদ, ঘটনা, কোন সংখ্যা বা বিশ্লেষণের সত্যতা যাচাই করতে মানুষ আজও ছাপা পত্রিকার ওপরই নির্ভর করে। ইন্টারনেট-নির্ভর সংবাদ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত সংবাদ হালনাগাদ হতে থাকে, ব্রেকিং নিউজ আসতে থাকে। সংবাদ যখন পত্রিকায় ছাপা হয়, তখন তা যে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, তা অস্বীকারের উপায় নেই। এ জন্য বলা হয়, ছাপা হচ্ছে প্রমাণ। আর ইন্টারনেট অনেক সময় খবর ও গুজব দুটোরই উৎস হয়ে দাঁড়ায়।

সংবাদপত্র সব সময়ই আয়ের জন্য বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করে এসেছে। ছাপা সংস্করণের পাশাপাশি ইন্টারনেট বা অন লাইন সংস্করণে বিজ্ঞাপন বা ভিডিও বা অডিও কন্টেন্টের মাধ্যমে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। একজন প্রতিবেদক রিপোর্ট করার পাশাপাশি তার স্মার্ট মোবাইল দিয়ে অডিও বা ভিডিও রেকর্ড করে নিতে পারেন। সেটি তাৎক্ষণিক ভাবে মেইলে অফিসে পাঠানোও যেতে পারে। এ কনটেন্ট ফেইসবুক, ইউটিউব, ইনস্ট্রাগ্রাম বা অন্যান্য মাধ্যমে দিয়ে আয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে সংবাদকর্মী তার উৎপাদনশীলতা এমনভাবে বাড়াতে পারেন যার সাথে সরাসরি প্রতিষ্ঠানের উপার্জন সম্পৃক্ত হয়।

 

এটি ঠিক যে, সমকালীনতাকে ধারণ করে পাঠকদের গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে। পাঠককে শুধু সংবাদ দিলে আর চলবে না। সেই সঙ্গে অবশ্যই মতামত আর বিশ্লেষণ দিতে হবে। পাঠকের সংখ্যা যাতে না কমে, সে জন্য সংবাদমাধ্যম চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দুনিয়াজুড়েই ছাপা পত্রিকায় একটা ভাটার টান শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাবলম্বী থেকে ছাপা মাধ্যমকে এবং বৈদ্যুতিক মাধ্যমকেও প্রাসঙ্গিক রাখতে প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে। প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য এ হালনাগাদ থাকার কাজে যারা সফল হচ্ছে তারা টিকে যাচ্ছে আর যারা তা পারছে না তারা হারিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সংবাদ মোবাইল ফোনে পাঠ করা হয়। এখন দ্রæততম মাধ্যম হিসাবে মানুষ এটাই বেছে নিচ্ছে। ফলে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার সাথে সংশ্লিষ্টদের এ পরিবর্তনশীল বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে হবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ছাপা এবং ডিজিটাল মাধ্যমের সমন্বয় করা গেলে প্রচলিত গণমাধ্যম প্রাসঙ্গিক থাকবে। সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যায়নি, তবে ভবিষ্যৎ রয়েছে ইতিবাচক সাংবাদিকতার। ছাপা, অনলাইন বা অন্য যে মাধ্যমই হোক, সংবাদ তথ্য প্রবাহ আর সাংবাদিকতা থাকবেই। এ জন্যই সাংবাদিকতায় মেধা ও সৃষ্টিশীলতা বিনিয়োগ করতে হবে।

 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে সত্যগুলো উঁকি দিচ্ছে, সেগুলো অবজ্ঞা করার কোনো উপায় নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সবকিছু অসত্য, এমনটাও ঠিক নয়। ছাপাসংক্রান্ত সমস্যা চলে আসছে বহুদিন ধরে। গণতন্ত্র বা মত প্রকাশের সমস্যাও একদিনে কাটবে এমনটি ভাবার কারণ নেই। এসব মোকাবিলা করেও বাংলাদেশে সংবাদপত্র যে মাত্রাতেই হোক না কেন সাহসের সঙ্গে কাজ করে আসছে। যদিও এটি ঠিক যে সাংবাদিকরা সব লিখতে পারেন না, যা বলা উচিত, তার সব বলতে পারেন না। ভয়ভীতিমুক্ত হয়ে বাকস্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা করা যায় না। সংশোধিত আইসিটি আইন-২০১৩ এবং ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কিছু আইন সাংবাদিকতাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। অনেক সাংবাদিক ইতিমধ্যে এ আইনের হাতে দমনের শিকার হয়েছেন।

 

বিশ্বজুড়েই সাংবাদিকেরা এমন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানেও ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ আর ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এর মতো পত্রিকা হোয়াইট হাউস থেকে প্রেসিডেন্টের চাপের শিকার হচ্ছে। অন্য দেশেও একই রকমের নজির রয়েছে। এতো কিছুর মধ্যেও সাংবাদিকতা আর সংবাদপত্র বিকশিত হচ্ছে। ইবনে খালদুনের সমাজের যে আবর্তন তত্ব তাতে প্রাকৃতিক নিয়মেই সবকিছু পরিবর্তন হবার কথা বলা হয়েছে। কয়েক দশকের গণতন্ত্র চর্চার পর স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা হয়তোবা এখানে চেপে বসেছে। এর পর আবার রাত পেরিয়ে সকাল হবে। সাংবাদিকদের পেশা পাল্টাতে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ বন্ধ করতে হবে না। প্রতিকূলতা পেরিয়ে সাংবাদিকতার সোনালি দিন আবার আসবে। কেবল অবস্থার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে। দক্ষতা ও কর্মক্ষমতাকে বৈচিত্রপূর্ণ ও বহুমুখি করতে হবে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © 2022 SOFT-MACK
Design & Developed BY SOFT-MACK